বাংলাদেশের সংগীতজগতে এক অনন্য নাম আসিফ আকবর। তার কণ্ঠে ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ গানটি প্রকাশের পর থেকে দেশের শ্রোতাদের হৃদয়ে এক অমলিন জায়গা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি আবার তিনি আলোচনায় এসেছেন অন্য পরিচয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক হিসেবে। গায়ক থেকে ক্রিকেট প্রশাসক-এ রকম ভিন্নধর্মী যাত্রা কৌতূহল জাগিয়েছে সবার মাঝে। চলুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক আসিফ আকবরের জন্ম, শৈশব, কিশোর, শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবন ও ক্যারিয়ারের নানা দিক।
জন্ম ও শৈশব
আসিফ আকবরের জন্ম ২৫ মার্চ ১৯৭২ সালে কুমিল্লা শহরে। ঐতিহ্যবাহী এ শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়ে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন সাধারণ জীবনযাত্রার আবহে। ছোটবেলা থেকেই গান শোনার অভ্যাস ছিল তার। তবে সংগীতে পেশাদার হওয়ার কথা তখন ভাবেননি। খেলাধুলা, বিশেষ করে ক্রিকেট, তার শৈশব-কিশোরের বড় অংশ জুড়ে ছিল।

কৈশর ও পড়াশোনা
আসিফ আকবর কুমিল্লার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। কৈশর থেকেই তিনি ছিলেন চঞ্চল, প্রাণবন্ত ও আত্মবিশ্বাসী। খেলাধুলায় দারুণ আগ্রহী হলেও শিক্ষাজীবন অবহেলা করেননি। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। বন্ধুদের আড্ডায় গান গাইতেন, খেলাধুলায় অংশ নিতেন-সব মিলিয়ে বহুমুখী প্রতিভার ছাপ ছিল তার মধ্যে।
আরও পড়ুন: লিওনেল মেসি: কিংবদন্তি ফুটবলারের জীবন, অর্জন ও বিশ্বজয়ের গল্প
সঙ্গীতে আগমন
২০০১ সালে প্রকাশিত হয় আসিফ আকবরের প্রথম একক অ্যালবাম ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’। এই অ্যালবাম প্রকাশের পর তিনি রাতারাতি তারকায় পরিণত হন। দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে এমন সাড়া আগে খুব কমই দেখা গেছে। বলা হয়ে থাকে, অ্যালবামটি বাংলাদেশে সর্বাধিক বিক্রি হওয়া অ্যালবামগুলোর একটি।
এরপর থেকে একের পর এক জনপ্রিয় অ্যালবাম প্রকাশ করতে থাকেন তিনি। ‘তুমি ভিজে যাওনি কেন’, ‘সাদা ময়ূরী’, ‘মায়াবী চোখ’, ‘চোখের আলোয়’, ‘জীবন সংসার’-এরকম অসংখ্য গান তাকে অমর করেছে শ্রোতাদের হৃদয়ে। শুধু আধুনিক গান নয়, ভিন্ন ধারার গানেও তিনি নিজের স্বকীয়তা প্রমাণ করেছেন।

ভিন্ন ভূমিকায় আসিফ
সংগীতজীবনের সাফল্যের পাশাপাশি লেখালেখিতেও হাতেখড়ি রয়েছে তার। আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশ করে পাঠকদের কাছ থেকেও প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়া টেলিভিশন টকশো ও সামাজিক মাধ্যমে তার সরব উপস্থিতি তাকে ভিন্নভাবে আলোচনায় রেখেছে।
ক্রিকেটপ্রেম ও বিসিবিতে পদ
আসিফ আকবরের ক্রিকেটপ্রেম নতুন কিছু নয়। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসতেন তিনি। বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে বল-ব্যাট হাতে খেলেছেন, খেলা নিয়ে আড্ডা দিয়েছেন-ক্রিকেট তার জীবনের অংশ হয়ে আছে বরাবর। এই ভালোবাসার টান থেকেই সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। সঙ্গীত থেকে উঠে আসা একজন মানুষের ক্রিকেট প্রশাসনে জায়গা করে নেওয়া বিরল ঘটনা। তবে আসিফ বিশ্বাস করেন, ক্রিকেটের উন্নয়নে তিনি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবেন।

আরও পড়ুন: হামজা চৌধুরী: বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ফুটবলারের অনন্য পথচলা
ব্যক্তিজীবন
ব্যক্তিজীবনে আসিফ আকবর একাধারে পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল স্বামী ও পিতা। তার স্ত্রীর নাম শিল্পী আকবর। দাম্পত্য জীবনে তাদের দুই সন্তান রয়েছে এক ছেলে এবং এক মেয়ে। পরিবারের সঙ্গে গভীর বন্ধনই তাকে সবসময় শক্তি জুগিয়েছে বলে উল্লেখ করেন আসিফ। গান, মঞ্চ, টেলিভিশন-যেখানেই ব্যস্ত থাকুন না কেন, সময় পেলেই তিনি পরিবারকে সময় দিতে ভালোবাসেন। খ্যাতি, জনপ্রিয়তা কিংবা বিতর্ক-সবকিছুর ভেতর দিয়েই তার সবচেয়ে বড় আশ্রয় ছিল এই পরিবার।
জনপ্রিয়তা ও বিতর্ক
আসিফ আকবরের ক্যারিয়ার যেমন সাফল্যমণ্ডিত, তেমনি কিছু বিতর্কও তার সঙ্গে যুক্ত। কপিরাইট ইস্যু, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বক্তব্য—এসব নিয়েও তিনি আলোচনায় এসেছেন। তবে সব বিতর্ক পেরিয়েও তার গান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

নতুন অধ্যায়
গায়ক থেকে বিসিবি পরিচালক-এ যেন জীবনের এক ভিন্ন মাইলফলক। আসিফ আকবর নিজেই বলেছেন, জীবনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে তিনি পছন্দ করেন। সংগীত তাকে দিয়েছে তারকা খ্যাতি, আর ক্রিকেট প্রশাসন হয়তো দেবে নতুন পরিচয়।
আসিফ আকবর শুধু গায়ক নন; তিনি এক বহুমাত্রিক মানুষ। সংগীত, লেখালেখি, পরিবার, এখন আবার ক্রিকেট প্রশাসন-সবখানেই নিজের ছাপ রেখে চলেছেন। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন নতুন গল্পের জন্ম দেয়। সংগীতপ্রেমী শ্রোতারা যেমন তাকে হৃদয়ে বরণ করে নিয়েছেন, ক্রিকেটপ্রেমীরাও হয়তো দেখতে চাইবেন তিনি কীভাবে খেলাটির উন্নয়নে অবদান রাখেন।
বাংলাদেশি সংস্কৃতির ইতিহাসে আসিফ আকবর এক অনন্য নাম হয়ে থাকবে। সুরের ভুবন থেকে ক্রিকেট বোর্ড, জীবনের প্রতিটি পর্বেই তিনি আলাদা আলো ছড়াচ্ছেন।