24.2 C
New York
Sunday, June 22, 2025

Buy now

টেনিস কিংবদন্তি মারিয়া শারাপোভা: সাফল্য, বিতর্ক ও ব্যক্তিজীবন

টেনিসের ইতিহাসে যাদের নাম সোনার অক্ষরে লেখা, তাদের মধ্যে অন্যতম মারিয়া শারাপোভা। ছোটবেলা থেকেই কঠোর পরিশ্রম আর অবিচল সংকল্পের মাধ্যমে বিশ্বক্রীড়াঙ্গনে নিজের এক আলাদা ছাপ রেখেছেন তিনি। কোর্টের গর্জন আর ব্যস্ত জনজীবনের পেছনে লুকিয়ে আছে এক অনন্য গল্প-যা শুধু সাফল্যেরই নয়, বরং নানা বিতর্ক ও ব্যক্তিজীবনের নানা ওঠাপড়ারও সাক্ষী। এই আর্টিকেলে আমরা জানবো কিভাবে মারিয়া শারাপোয়া টেনিসের রাজকন্যা হয়ে ওঠেন, তার সাফল্যের শিখর, তার ব্যক্তিগত জীবনের দিকগুলো, এবং বিতর্ক যা কখনো তার ক্যারিয়ারের ছায়া ফেলেছে।

জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি
১৯৮৭ সালের ১৯ এপ্রিল সাইবেরিয়ার নাইাগান শহরে জন্মগ্রহণ করেন মারিয়া ইউরেভনা শারাপোভা। তার পিতা ইউরি এবং মাতা এলেনা; দুজনেই বেলারুশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক বিপর্যয় ‘চেরনোবিল’ থেকে পালিয়ে আসা মানুষ। মারিয়ার জন্মের কয়েক বছর আগেই তারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রাশিয়ার নাইাগানে চলে আসেন। পরবর্তীতে মারিয়ার পরিবার স্থানান্তরিত হয় সোচি শহরে, যেখানে তার টেনিসের হাতেখড়ি ঘটে।

শৈশব ও কৈশোর কঠিন পথচলার শুরু
মাত্র চার বছর বয়সে মারিয়া টেনিসের প্রতি আগ্রহ দেখান। তার প্রথম টেনিস র‍্যাকেট উপহার দেন ইউরি। ছয় বছর বয়সেই স্থানীয় কোচ ইয়েভগেনি কাফেলনিকভের নজরে পড়েন তিনি, যিনি মারিয়াকে প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর পরামর্শ দেন।

মাত্র সাত বছর বয়সে মা এলেনাকে ছেড়ে বাবার হাত ধরে আমেরিকার ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে রওনা দেন মারিয়া। সেখানে তিনি যোগ দেন নিক বোলেটিয়েরি টেনিস অ্যাকাডেমিতে। এই প্রতিষ্ঠানেই গড়ে ওঠে ভবিষ্যতের এক মহাতারকা। কিন্তু শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না। ভাষাগত বাধা, আর্থিক টানাপোড়েন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা-সব মিলিয়ে তার কৈশোর ছিল সংগ্রামী।

পেশাদার ক্যারিয়ারের উত্থান
২০০১ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে মারিয়া শারাপোভা পেশাদার টেনিসে অভিষেক করেন। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসেন ২০০৪ সালে, যখন তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন হন। ফাইনালে তিনি পরাজিত করেন কিংবদন্তি সেরেনা উইলিয়ামসকে। এই জয় তাকে রাতারাতি বিশ্ব তারকায় পরিণত করে। এরপর একে একে তিনি জয় করেন: ইউএস ওপেন (২০০৬), অস্ট্রেলিয়ান ওপেন (২০০৮), ফ্রেঞ্চ ওপেন (২০১২ ও ২০১৪)। এই পাঁচটি গ্র্যান্ড স্লাম জয় করে তিনি টেনিসের একমাত্র রাশিয়ান গ্র্যান্ড স্লাম ক্যারিয়ার গ্র্যান্ড স্ল্যাম উইনার হন। এছাড়া তিনি ৩৬টি ডব্লিউটিএ শিরোপাও জিতেছেন।

শীর্ষে অবস্থান ও জনপ্রিয়তা
২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্ব টেনিস র‌্যাঙ্কিংয়ে ১ নম্বর স্থান অর্জন করেন মারিয়া শারাপোভা। এছাড়াও তিনি বিশ্বের সর্বাধিক আয়কারী নারী ক্রীড়াবিদের তালিকায় বেশ কয়েকবার শীর্ষস্থান দখল করেন। কেবল কোর্টেই নয়, বিজ্ঞাপন জগতে, ফ্যাশন দুনিয়াতেও তিনি ছিলেন অন্যতম পরিচিত মুখ। Nike, Head, Porsche, Evian, Tag Heuer-এর মতো বহু ব্র্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি ছিল তার।

ব্যক্তিজীবন ও প্রেম
শারাপোভার ব্যক্তিজীবন ছিল নানা গুঞ্জনে ভরা। তিনি আমেরিকান বাস্কেটবল খেলোয়াড় সাশা ভুজাসিচের সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রেম করেন এবং একসময় বাগদানও হয়। যদিও তা ভেঙে যায় ২০১২ সালে। এছাড়াও ব্রিটিশ ব্যবসায়ী আলেকজান্ডার গিলকসের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন গণমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। ২০২২ সালে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়।

ব্যবসা উদ্যোগ ও লেখালেখি
খেলার পাশাপাশি মারিয়া ছিলেন একজন সফল উদ্যোক্তা। ২০১২ সালে তিনি নিজস্ব ক্যান্ডি ব্র্যান্ড ‘Sugarpova’ চালু করেন, যা বিশ্বব্যাপী বেশ জনপ্রিয় হয়। এছাড়া ২০১৭ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনী ‘Unstoppable: My Life So Far’ ছিল আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার। সেখানে তিনি তার জীবনের নানা অধ্যায় নিখুঁতভাবে তুলে ধরেন।

বিতর্ক ও নিষেধাজ্ঞা
২০১৬ সালে মারিয়া শারাপোভার ক্যারিয়ারে বড় ধাক্কা আসে। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের পর রুটিন ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে মেলডোনিয়াম নামক নিষিদ্ধ ওষুধের উপস্থিতি। এর ফলে আন্তর্জাতিক টেনিস ফেডারেশন তাকে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্ক তৈরি হয়। সমালোচকরা তার ওপর আস্থা হারালেও, ভক্তদের একটি বড় অংশ সবসময় তার পাশে ছিল। মারিয়া নিজেও বারবার বলেন, এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল এবং তিনি কখনোই প্রতারণার উদ্দেশ্যে কিছু নেননি।

Maria Sharapova, মারিয়া শারাপোভা, Tennis, Women's Tennis, Sports Biography, Grand Slam, Tennis Stars, Russian Athletes,

প্রত্যাবর্তন ও অবসর
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ২০১৭ সালে কোর্টে ফেরেন মারিয়া। তবে আগের মতো ছন্দ ফিরে পাননি। বারবার ইনজুরিতে পড়েন এবং পারফরম্যান্সেও ভাটা পড়ে। দীর্ঘ চিন্তাভাবনার পর ২০২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে টেনিস থেকে অবসর ঘোষণা করেন তিনি।

তিনি লিখেছিলেন, ‘টেনিস, আমি তোমাকে বলছি বিদায়।’ সেই বিদায় ছিল আবেগঘন এবং সম্মানজনক। বিশ্ব ক্রীড়া মহলে শারাপোভার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি
ডাব্লিউটিএ প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার
ইএসপিওয়াই অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ফিমেল টেনিস প্লেয়ার
আইটিএফ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন
রাশিয়ান অর্ডার অফ অনার
টিন চয়েস অ্যাওয়ার্ডস (মাল্টিপল ইয়ার্স)
এছাড়া ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে বহুবার বিশ্বের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী নারী খেলোয়াড় হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

মারিয়া শারাপোভার জীবন শুধুই একটি ক্রীড়াবিদের নয়, বরং এক যোদ্ধা নারীর গল্প। যিনি ছোট শহর থেকে উঠে এসে বিশ্বের ক্রীড়ামঞ্চে রাজত্ব করেছেন। তার ক্যারিয়ার যেমন সাফল্যে ভরা, তেমনি চড়াই-উতরাইয়েও পরিপূর্ণ। আলো, আধার, ব্যথা, গৌরব সব মিলিয়েই তিনি টেনিস বিশ্বের এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি হার মানেননি, এই এক শিক্ষা আমাদের প্রত্যেককে ছুঁয়ে যায়।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
3,913FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles