24.2 C
New York
Sunday, June 22, 2025

Buy now

ইমরান খানের ক্রিকেট-প্রেম-রাজনীতি ও বিতর্কে ভরা এক জীবন

‘ইমরান খান’ নামটা শুধু ক্রিকেট মাঠেই নয়, পাকিস্তানের রাজনীতির মঞ্চেও এক বিপ্লবের প্রতীক। তিনি যেমন ১৯৯২ সালে দেশের জন্য প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেট বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন, তেমনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে কোটি মানুষের প্রত্যাশার প্রতিমূর্তি হয়েছেন। একদিকে মাঠ কাঁপানো অলরাউন্ডার, অন্যদিকে গ্ল্যামারাস প্রেমকাহিনি ও বিতর্কে মোড়ানো রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সব মিলিয়ে ইমরান খানের জীবন এক সিনেমার চেয়ে কম নয়।

জন্ম, শৈশব, ক্রিকেট ক্যারিয়ার, বৈবাহিক জীবন থেকে শুরু করে কারাবাস; তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ঘিরে আছে আলোচনা, প্রশংসা ও সমালোচনার ঢেউ। চলুন জেনে নেই কিভাবে গ্ল্যামার, গৌরব আর গভীর বিতর্কে গড়া এই ব্যতিক্রমী যাত্রার নায়ক হয়ে উঠলেন পাকিস্তানের ‘পপুলার আইকন’ ইমরান খান।

Imran khan Debut, Pakistan Cricket, Imran Khan Biography, Prime Minister of Pakistan, World Cup 1992, PTI, Imran Khan Controversy, Imran Khan Family, Imran Khan Politics,

জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি
১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর পাকিস্তানের লাহোরে এক সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পশতু পরিবারে ইমরান আহমেদ খান নিজামী জন্ম। তার বাবা ইখতিয়ার খান ছিলেন একজন প্রকৌশলী এবং মা শওকত খানম ছিলেন গৃহিণী। ইমরানের পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানের নামকরা খান দানার অংশ, যাদের অনেকেই সরকারি এবং প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন
ইমরান খান শৈশবে ছিলেন শান্ত, আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী। তার স্কুলজীবন কেটেছে লাহোরের ‘ক্যাথিড্রাল স্কুল’ এবং পরবর্তীতে ‘এইচিসন কলেজ’-এ। এরপর তিনি যুক্তরাজ্যে যান পড়াশোনার জন্য। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিবল কলেজে পড়াশোনা করেন দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি (PPE) বিষয়ে। সেই সময়েই তার ক্রিকেট প্রতিভা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলো ছড়াতে শুরু করে।

কিশোর বয়সে ক্রিকেটের প্রতি টান
ইমরানের কিশোরকাল থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ছিল দুর্দান্ত আগ্রহ। ১৬ বছর বয়সে পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে তার অভিষেক। খুব কম সময়ে তার বোলিং ও ব্যাটিং দক্ষতা নজর কাড়ে নির্বাচকদের। তিনি ছিলেন একজন ক্লাসিক ফাস্ট বোলার এবং দক্ষ মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান। এমন অলরাউন্ডার তখন পাকিস্তানের ক্রিকেটে বিরল ছিল।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক
১৯৭১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ইমরান খানের। শুরুটা ছিল মিশ্র, তবে খুব দ্রুতই তিনি পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডারে পরিণত হন। ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের টেস্ট দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার অধিনায়কত্বে পাকিস্তান ক্রিকেট ইতিহাসের এক নতুন যুগে প্রবেশ করে।

ক্রিকেট ক্যারিয়ারে উত্থান ও অবদান
ইমরান খানের ক্রিকেট ক্যারিয়ার ২০ বছরেরও বেশি সময়জুড়ে বিস্তৃত। তিনি খেলেছেন ৮৮টি টেস্ট ম্যাচ ও ১৭৫টি ওয়ানডে। টেস্টে তার রান ছিল ৩৮০৭ এবং উইকেট ৩৬২টি। ওয়ানডেতে রান করেছেন ৩৭০৯ ও উইকেট নিয়েছেন ১৮২টি। অলরাউন্ডারের সংজ্ঞা যদি কাগজে লিখতে হয়, তবে ইমরান খানের নামই যথেষ্ট।

১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ: চূড়ান্ত জয়
ইমরানের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ অর্জন আসে ১৯৯২ সালে। তখন তার বয়স প্রায় ৪০। অধিনায়ক হিসেবে পাকিস্তানকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতান তিনি। সিডনিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনালে দুর্দান্ত খেলে পাকিস্তান জয় লাভ করে। ইমরানের বিশ্বকাপ জয়ের কাহিনি এখনো তরুণদের অনুপ্রেরণা জোগায়।

অবসরের পর: মানবসেবায় মনোনিবেশ
ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর ইমরান খান নিজেকে মানবসেবায় নিয়োজিত করেন। মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতাল’। এটি পাকিস্তানের প্রথম ক্যানসার হাসপাতাল, যেখানে বহু মানুষ সেবা পেয়েছে বিনামূল্যে। তিনি গড়ে তোলেন ‘নামল ইউনিভার্সিটি’ও, যার লক্ষ্য ছিল গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া।

রাজনীতির পথে যাত্রা
১৯৯৬ সালে ইমরান খান রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং গঠন করেন ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (PTI)। শুরুটা ছিল চরম অনিশ্চয়তায় ভরা। প্রথম দশকে রাজনৈতিক মঞ্চে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেননি। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে তার দল জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জয় ও প্রধানমন্ত্রিত্ব
২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে PTI বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এরপর ইমরান খান পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জনগণের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী; দুর্নীতিমুক্ত দেশ, ভালো অর্থনীতি ও ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রিত্বের চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য
ইমরান খানের শাসনামলে পাকিস্তানের অর্থনীতি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যায়। তবে তিনি চেষ্টা করেন দারিদ্র্য হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, ও বৈদেশিক নীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে। ‘এহসাস প্রোগ্রাম’ এবং ‘সেহত কার্ড’-এর মতো সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিরোধীদের চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে।

ক্ষমতা থেকে বিতাড়ন
২০২২ সালের এপ্রিল মাসে একটি অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে সংসদে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি দাবি করেন, এটি ছিল বিদেশি ষড়যন্ত্র। এরপর থেকে তিনি আবার গণআন্দোলন ও নির্বাচনের দাবি নিয়ে রাজপথে সক্রিয় হন।

ব্যক্তিজীবন ও বিবাহিত জীবন
ইমরান খানের ব্যক্তিজীবন নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ১৯৯৫ সালে বিয়ে করেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত জেমিমা গোল্ডস্মিথকে। তাদের দুই সন্তান হলেও ২০০৪ সালে এই দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। এরপর তিনি বিয়ে করেন সাংবাদিক রেহাম খানকে, তবে সেই সম্পর্কও বেশি দিন টেকেনি।

২০১৮ সালে ইমরান খান বিয়ে করেন ধর্মীয় চিন্তাবিদ বুশরা মানেকাকে। এই বিয়ে নিয়েও নানা মত ও আলোচনার সৃষ্টি হয় পাকিস্তানের গণমাধ্যমে।

বিতর্ক ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু
ইমরান খান বরাবরই বিতর্কিত এক চরিত্র। কখনো তার খেলোয়াড়ি জীবনের ‘প্লেবয়’ ইমেজ, আবার কখনো রাজনৈতিক মন্তব্য; সব কিছুই তাকে বারবার সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে এনেছে। রেহাম খানের লেখা আত্মজীবনীতে উঠে আসে অনেক ব্যক্তিগত তথ্য, যা তাকে রাজনৈতিকভাবে বেশ বিব্রত করেছে।

জেলে যাত্রা ও রাজনৈতিক হামলা
২০২৩ সালে দুর্নীতির অভিযোগে ইমরান খানকে গ্রেফতার করা হয়। এতে দেশজুড়ে উত্তাল হয়ে ওঠে আন্দোলন। তার সমর্থকরা ব্যাপক প্রতিবাদ করে এবং সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। ফলে আবার গ্রেফতার হন অনেক PTI নেতাকর্মী। এ ছাড়া তার ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে, যা তার রাজনৈতিক জীবনের ভয়াবহ দিক তুলে ধরে।

ইমরান খানের প্রভাব ও উত্তরাধিকার
ইমরান খান শুধু একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার বা রাজনীতিবিদ নন; তিনি এক প্রতীক। পাকিস্তানের মানুষের কাছে তিনি এক সম্ভাবনার নাম, এক সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি। তার জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয় এক ব্যক্তি যদি ইচ্ছাশক্তি ও নিষ্ঠা দিয়ে এগিয়ে চলে, তবে ইতিহাসও বদলে যেতে পারে।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
3,913FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles