24.2 C
New York
Sunday, June 22, 2025

Buy now

লিওনেল মেসি: কিংবদন্তি ফুটবলারের জীবন, অর্জন ও বিশ্বজয়ের গল্প

১৯৮৭ সালের ২৪ জুন, আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে জন্ম নেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি কুচিত্তিনি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া এই শিশু একদিন বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাস পাল্টে দেবে তা কে জানত? মেসির বাবা জর্জ মেসি ছিলেন একটি কারখানার কর্মী আর মা সেলিয়া কুচিত্তিনি ছিলেন ক্লিনার। চার ভাই-বোনের মধ্যে মেসি ছিলেন সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ছিল। তিন বছর বয়সেই বল নিয়ে খেলা শুরু করেন এবং পাঁচ বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব গ্র্যান্ডোলিতে যোগ দেন, যেখানে তার বাবা ছিলেন কোচ।

শৈশবের চ্যালেঞ্জ ও প্রতিভার উন্মেষ
মেসির ফুটবল প্রতিভা ছোটবেলা থেকেই স্পষ্ট ছিল। মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি যোগ দেন নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবে। কিন্তু ১১ বছর বয়সে একটি বড় ধাক্কা আসে তার জীবনে। তার শরীরে গ্রোথ হরমোনের ঘাটতি ধরা পড়ে, যার কারণে শরীর স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল না। এই চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল, যা মেসির পরিবার বহন করতে পারছিল না।

এই সময়টাতেই মেসির জীবনে এক মোড় আসে। আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলো যখন তাকে ফিরিয়ে দেয়, তখন বার্সেলোনার এক স্কাউট মেসির প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ট্রায়ালের জন্য স্পেনে নিয়ে যান। সেখানে ক্লাবের এক কর্মকর্তার হাতে একটি ন্যাপকিনে লেখা হয় বার্সেলোনায় চুক্তির প্রস্তাব। আর তাতেই শুরু হয় মেসির ইউরোপ যাত্রা।

বার্সেলোনায় স্বপ্নের সূচনা
২০০০ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে পরিবারসহ স্পেনে চলে যান মেসি। লা মাসিয়া, বার্সেলোনার ইয়ুথ একাডেমিতে যোগ দেন তিনি। সেখানেই দিনে দিনে ফুটবলের ছন্দে বেড়ে উঠতে থাকেন মেসি। ২০০৩ সালে বার্সেলোনার ‘সি’ দলে খেলা শুরু করেন, এরপর ‘বি’ দলে এবং ২০০৪ সালে ১৭ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো বার্সেলোনার মূল দলে অভিষেক হয় তার।

তবে আসল ঝলক আসে ২০০৫ সালে, যখন মেসি তার প্রথম লা লিগা গোল করেন। সেই গোলের ধরন ছিল অনেকটাই ডিয়েগো ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের মতো। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

মেসি ও গার্দিওলার বার্সা: স্বর্ণযুগের গল্প
২০০৮ সালে পেপ গার্দিওলা বার্সেলোনার কোচ হওয়ার পরই শুরু হয় এক অবিস্মরণীয় যুগ। গার্দিওলার অধীনে বার্সা হয়ে ওঠে এক অব্যর্থ যন্ত্র, আর সেই যন্ত্রের হৃদয় ছিলেন মেসি। তার সঙ্গে জাভি, ইনিয়েস্তা, বুসকেটস, পিকেদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক অবিশ্বাস্য দল।

২০০৯ সালে মেসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে হেড দিয়ে গোল করে বার্সেলোনাকে ইউরোপ সেরা করেন। সেই মৌসুমে তিনি জেতেন তার প্রথম ব্যালন ডি’অর। এরপর আরও ছুটে চলা ২০১২ সালে গড়েন এক বছরে সর্বোচ্চ ৯১ গোলের বিশ্বরেকর্ড। তার স্ট্যামিনা, পাসিং, ড্রিবলিং, প্লে-মেকিং সবই ছিল অভাবনীয়।

জাতীয় দলের গল্প: সমালোচনা থেকে শ্রেষ্ঠত্ব
মেসির জাতীয় দলের ক্যারিয়ার অনেকটাই চড়াই-উৎরাইয়ের গল্প। ২০০৫ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জেতার মাধ্যমে শুরু হয় তার আন্তর্জাতিক ফুটবল যাত্রা। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে জেতেন স্বর্ণপদক।

তবে সিনিয়র দলে দীর্ঘদিন ধরে বড় কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি না পাওয়ায় তাকে নিয়ে সমালোচনাও ছিল তুঙ্গে। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরে যান জার্মানির কাছে। এরপর ২০১৫ ও ২০১৬ কোপা আমেরিকার ফাইনালেও হেরে জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন, যদিও পরে সিদ্ধান্ত বদলান।

অবশেষে ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতে সমালোচনার জবাব দেন মেসি। আর ২০২২ সালে, কাতার বিশ্বকাপে এনে দেন ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য আর্জেন্টিনার হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি। ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে দেশকে এনে দেন তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়।

পিএসজি অধ্যায় এবং আমেরিকা যাত্রা
২০২১ সালে বার্সেলোনার আর্থিক সংকটের কারণে দীর্ঘ ২১ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় ক্লাবটির সঙ্গে। এরপর মেসি যোগ দেন ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেই (PSG)-তে। সেখানে কিলিয়ান এমবাপে ও নেইমারকে নিয়ে গড়ে তোলেন নতুন ত্রয়ী।

দুই বছর পিএসজিতে খেলার পর ২০২৩ সালে মেসি ইউরোপিয়ান ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেন। ডেভিড বেকহ্যামের মালিকানাধীন ক্লাবে যুক্ত হয়ে আমেরিকান ফুটবলে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন তিনি। সেখানে লিগ কাপ জিতিয়ে নিজের যাত্রাকে আরও বর্ণময় করে তুলেছেন।

ব্যক্তিজীবনের পেছনের নায়ক-নায়িকা
মাঠের বাইরেও মেসি এক অনন্য মানুষ। ছোটবেলার প্রেম অ্যান্টোনেল্লা রোকুজ্জোর সঙ্গে বহু বছর প্রেমের পর ২০১৭ সালে বিয়ে করেন তিনি। তাদের তিন সন্তান-থিয়াগো, মাতেও ও সিরো। মেসির পরিবার-প্রেম ও সাধারণ জীবনের প্রতি টান তাকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়। বিলাসিতা থেকে দূরে থাকা এই সুপারস্টার সময় কাটান স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে।

তিনি নানা দাতব্য কার্যক্রমেও যুক্ত। ‘লিও মেসি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন তিনি।

অর্জন ও পুরস্কারের ঝলমলে তালিকা
লিওনেল মেসির ফুটবল ক্যারিয়ার পুরস্কার আর রেকর্ডের এক সুবিশাল খনি। তার কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো:

ক্লাব পর্যায়ে:
১০ বার লা লিগা চ্যাম্পিয়ন (বার্সেলোনা)
৭ বার কোপা দেল রে জয়ী
৪ বার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী (২০০৬, ২০০৯, ২০১১, ২০১৫)
৩ বার ক্লাব বিশ্বকাপ জয়
৮ বার স্প্যানিশ সুপার কাপ জয়

জাতীয় দলের হয়ে:
ফিফা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন: ২০২২
কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন: ২০২১, ২০২৪
আন্ডার-২০ বিশ্বকাপ: ২০০৫
অলিম্পিক স্বর্ণপদক: ২০০৮
ফিনালিসিমা জয়: ২০২২

ব্যক্তিগত সম্মাননা:
৮ বার ব্যালন ডি’অর (সর্বোচ্চ সংখ্যক)
৬ বার ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু
২২ বার বার্সেলোনার মৌসুমসেরা খেলোয়াড়
১০০০+ ক্যারিয়ার ম্যাচ খেলা
৮০০+ গোল (ক্লাব ও জাতীয় দল মিলিয়ে)

মেসি একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি তিনটি আলাদা দশকে (২০০০, ২০১০, ২০২০) সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি ফিফার সর্বাধিক ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ জয়ী, চ্যাম্পিয়নস লিগে সর্বাধিক অ্যাসিস্ট প্রদানকারী এবং বিশ্বকাপে সর্বাধিক ম্যাচ খেলা খেলোয়াড়দের একজন।

লিওনেল মেসির গল্প শুধু ফুটবলের নয়, এটি এক অদম্য স্বপ্নের গল্প যেখানে সীমাবদ্ধতা নেই, শুধুই সম্ভাবনা। প্রতিকূলতা জয় করে কীভাবে বিশ্ব শীর্ষে ওঠা যায়, তার জীবন্ত উদাহরণ মেসি। তিনি কেবল আর্জেন্টিনার নয়, তিনি গোটা বিশ্বের সম্পদ। একাধারে শিল্পী, যোদ্ধা আর অনুপ্রেরণা মেসি ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
3,913FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles