নড়াইলের মাটিতে জন্ম নেওয়া মাশরাফি যেমন দেশের ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় তুলেছেন, তেমনি রাজনীতির মঞ্চেও নিজের জায়গা করে নিয়েছেন দৃঢ়তায়। তবে এই পথ সমালোচনা, প্রশ্ন, প্রত্যাশা আর বিতর্কে ভরপুর।
ক্রিকেট মাঠে তিনি ছিলেন আগুনঝরা নেতা, যিনি আহত হাঁটুতেও দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই মাশরাফি বিন মর্তুজাই এখন সমালোচিত রাজনীতিবিদ। নড়াইলের মাটিতে জন্ম নেওয়া এই তারকা যেমন দেশের ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় তুলেছেন, তেমনি রাজনীতির মঞ্চেও নিজের জায়গা করে নিয়েছেন দৃঢ়তায়।
তবে এই পথ সমালোচনা, প্রশ্ন, প্রত্যাশা আর বিতর্ক ভরপুর। কেউ বলেন, তিনি রাজনীতিতে আগেভাগেই নেমেছেন; কেউ আবার মনে করেন, তিনি দলের ভেতরেও এক ভিন্ন সুরের মানুষ। তবু সবকিছুর পরেও মাশরাফি রয়েছেন নিজের বিশ্বাসে অটল সামলোচনাকে তোয়াক্কা না করেই চলছেন আপন নিয়মে।

আজ ৫ অক্টোবর, নড়াইলের সন্তান মাশরাফি বিন মর্তুজার জন্মদিন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি শুধু একজন সফল অধিনায়ক নন, বরং এক মানসিক শক্তির নাম। ক্রিকেটের বাইরেও তিনি এখন পরিচিত একজন রাজনীতিক হিসেবে। একদিকে ক্রিকেটের জনপ্রিয় নায়ক, অন্যদিকে রাজনীতির বিতর্কিত চরিত্র-এই দুই বিপরীত চিত্র যেন একই ফ্রেমে মিশে গেছে মাশরাফির জীবনে।
১৯৮৩ সালের এই দিনে নড়াইল জেলার একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম মাশরাফি বিন মর্তুজার। শৈশব থেকেই ছিলেন প্রাণবন্ত, দৌড়ঝাঁপপ্রিয়, চঞ্চল এক কিশোর। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় ছিল তার গভীর টান। কখনও নদীতে সাঁতার কাটা, কখনও মাঠে ফুটবল-সবখানেই যেন তিনি ছিলেন সবার প্রিয় ‘ম্যাশ’। তবে সময়ের সঙ্গে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাই তাকে টেনে নেয় এক অন্য জগতে।
নড়াইল সরকারি হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই তার বোলিং দক্ষতার পরিচয় মেলে। বন্ধুদের চোখে তিনি ছিলেন ‘দুরন্ত বোলার’, যার বলে স্টাম্প উড়ে যাওয়া ছিল নিয়মিত ঘটনা। স্থানীয় কোচরা দ্রুত বুঝে ফেলেন-এই ছেলেটি একদিন বড় কিছু করবে। কিন্তু সেই পথ ছিল না একদম সহজ। আর্থিক সীমাবদ্ধতা, সুযোগের অভাব, আর পরিশ্রমের সীমাহীন চ্যালেঞ্জ পেরিয়েই মাশরাফি পৌঁছেছেন জাতীয় দলে।
২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় মাশরাফির। প্রথম ম্যাচেই তার আগ্রাসী বোলিংয়ে চমকে যায় ক্রিকেটবিশ্ব। বাংলাদেশ পায় তার প্রথম প্রকৃত ফাস্ট বোলার। কিন্তু সেই শুরুতেই শুরু হয় চোটের সঙ্গে যুদ্ধ। হাঁটুর ইনজুরি যেন তাকে বারবার পেছনে টেনে ধরেছে। তবু মাশরাফি হাল ছাড়েননি। ৭ বার অপারেশনের পরও তিনি ফিরে এসেছেন মাঠে। যেন এক জীবন্ত উদাহরণ, ‘অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে কিছুই অসম্ভব নয়।’

২০১৪ সালে তিনি যখন বাংলাদেশ দলের ওয়ানডে অধিনায়ক হন, তখন দলটি ছিল আত্মবিশ্বাসহীন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একে একে হারিয়েছে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দল। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ, তারপর ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি-সব জায়গায়ই ছিল মাশরাফির প্রভাব। তিনি ছিলেন সেই নেতা, যিনি কাঁধে ব্যান্ডেজ, মুখে হাসি, আর মনে সাহস নিয়ে মাঠে নেমেছেন দলের জন্য। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আত্মবিশ্বাসের নতুন যুগের সূচনা ঘটেছিল তার হাত ধরেই।
রাজনীতিতে আগমন
২০১৮ সালে মাশরাফি বিন মর্তুজা যোগ দেন রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নড়াইল-২ আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। ক্রিকেট মাঠের নায়ক তখন পরিণত হন রাজনীতির মানুষে। অনেকে তাকে স্বাগত জানালেও, অনেকের চোখে ছিল প্রশ্ন-একজন ক্রিকেট তারকা রাজনীতিতে এলে কি সত্যিই পরিবর্তন আনা যায়?

রাজনীতিতে আসার পর থেকেই শুরু হয় সমালোচনা। কেউ কেউ মনে করেন, মাশরাফি সংসদে যতটা সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল, ততটা নন। আবার কেউ বলেন, রাজনীতিতে আসার পর তিনি ক্রিকেট থেকে আগেভাগেই দূরে সরে গেছেন।
রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর মাশরাফি বিন মর্তুজার মধ্যে অনেকেই দেখেছিলেন পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইমরান খানের ছায়া। ভেবেছিলেন, ইমরান যেমন খেলাধুলার জনপ্রিয়তা থেকে উঠে এসে রাজনীতিতে নতুন এক ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, মাশরাফিও তেমনি একদিন ক্রিকেটের নায়ক থেকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের নেতা হয়ে উঠবেন। কিন্তু সময়ের বাস্তবতায় সেই প্রত্যাশা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে তার উপস্থিতি প্রথমদিকে যতটা আলোচিত ছিল, পরবর্তী সময়ে ততটাই নীরব হয়ে ওঠে। তাকে চিনতে খুব বেশি সময় লাগেনি জনসাধারণের। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ছিল ২০১৮ সালের রাতের ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপুলভোটে জয়লাভ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার নানা সিদ্ধান্ত ও মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে একাধিকবার। বিশেষ করে করোনাকালে তার এলাকায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও নিজের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল।
২০২৪ সালে দেশজুড়ে যখন ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ বইছিল, তখন নীরব ছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। রাজনীতির মাঠে তার নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আলোচনা যেমন হয়েছে, তেমনি হতাশাও প্রকাশ করেছেন অনেকে। একসময় মাঠে দেশের জন্য প্রাণ উজাড় করে দেওয়া এই মানুষটি এবার যেন দূর থেকে দেখছিলেন সময়ের প্রবল পরিবর্তন।
মাশরাফির কাছ থেকে অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন নেতৃত্বের বার্তা, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান কিংবা অন্তত তরুণদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতীকী আহ্বান। কিন্তু তিনি ছিলেন নীরব। তার সেই নীরবতা ব্যাখ্যা করেছেন কেউ পরিপক্বতার প্রতিফলন হিসেবে, আবার কারও চোখে তা দায়িত্বহীনতা।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে জনজীবনে তার উপস্থিতি অনেকটা সীমিত। কেউ বলেন, তিনি আড়াল বেছে নিয়েছেন আত্মসমালোচনার জন্য; কেউ মনে করেন, তিনি সময়ের অপেক্ষায় আছেন।
মাশরাফির ব্যক্তিজীবনে তিনি এক নিবেদিত পরিবারের মানুষ। স্ত্রী সুমনা হক সুমি ও দুই সন্তানসহ তার জীবনে সরলতা ও সংযমের ছাপ স্পষ্ট। ক্রিকেট মাঠে যেমন তিনি লড়াকু, পরিবারে তেমনি দায়িত্বশীল ও নম্র।